মসলিন কাপড়- বাংলার হারিয়ে যাওয়ার গর্ব"
বাংলার বস্ত্রশিল্পের ঐতিহ্য বেশ পুরনো। মোগল আমলে বাংলার রাজধানী ঢাকায়স্থানান্তরিত হওয়ার পর ঢাকায় বিশেষ এক ধরনের অতি সূক্ষ্ম কাপড় তৈরি করাহতো; যা মসলিন নামে খ্যাত ছিল। মসলিন কাপড়েরবুনন
অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও মিহি হওয়ার কারণে ১৮৫১ সালে লন্ডনের বস্ত্রপ্রদর্শনীতে ঢাকাই মসলিন বিশেষ প্রাধান্য পায় এবং দর্শকদের মুগ্ধ করে।মসলিনের বিভিন্ন ধরন ছিল। আর সবচেয়ে সূক্ষ্ম মসলিন কাপড়ের নাম ছিল মলমল।মলমল ছিল সে সময় সবচেয়ে দামি বস্ত্র এবং এক প্রস্থ মলমল তৈরি করতে তাঁতিদেরছয় মাস পর্যন্ত সময় লেগে যেত। মোগল সম্রাট ও অভিজাতদের পৃষ্ঠপোষকতাতেই সেসময় মসলিন শিল্পের প্রসার ঘটে। এক হিসাবে দেখা যায়, ১৭৪৭ সালে ঢাকা থেকে যেপরিমাণ মসলিন কাপড় রপ্তানি ও নবাবদের জন্য সংগ্রহ করা হতো তার মূল্য ছিল২৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা। কিন্তু পলাশীর যুদ্ধের পর থেকে মূল্যবান এই কাপড়বিপর্যয়ের মুখে পরে এবং ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লবের পরে দেশি বাদশাহ্, নবাবও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে পুরোপুরি বিলীন হয়ে যায় ঐতিহ্যবাহী এই সূক্ষ্ম বস্ত্র।
শব্দের উৎস
বাংলা মসলিন শব্দটি আরবি, ফারসি কিংবা সংস্কৃতমূল শব্দ নয়।মসলিন নামটির উৎপত্তি সম্পর্কে সঠিক তথ্যপাওয়া না গেলেও এস. সি. বার্নেল ও হেনরি ইউল নামের দুজন ইংরেজ কর্তৃক প্রকাশিত অভিধান "হবসন জবসন"-এ উল্লেখ করা হয়েছে মসলিন শব্দটি এসেছে 'মসূল' থেকে। ইরাকের এক বিখ্যাত ব্যবসাকেন্দ্র হলো মসূল। এই মসূলেও অতি সূক্ষ্ম কাপড় প্রস্তুত হতো। এই 'মসূল' এবং 'সূক্ষ্ম কাপড়' -এ দুয়ের যোগসূত্র মিলিয়ে ইংরেজরা অতিসূক্ষ্ম কাপড়ের নাম দেয় 'মসলিন'।অবশ্য বাংলার ইতিহাসে 'মসলিন' বলতে বোঝানো হয় তৎকালীন ঢাকা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে উৎপাদিত অতি সূক্ষ্ম একপ্রকার কাপড়কে।
বিবরণ
মসলিন মূলতো প্রস্তুত করা হতো পূর্ব বাংলার সোনারগাঁও অঞ্চলে। ঢাকার কয়েকটি স্থান ছিল উৎকৃষ্টমানের মসলিনতৈরির জন্য প্রসিদ্ধ। তবে কিশোরগঞ্জের জঙ্গলবাড়িতে অত্যন্ত সূক্ষ্ম মসলিনকাপড় তৈরি করা হতো; কারণ এই এলাকাটি মসলিন তৈরির উপযোগী তুলা উৎপাদনকারীস্থানের কাছাকাছি ছিল। ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে জন্মানো ফুটি নামের এক ধরনেরতুলা থেকে যে সুতা পাওয়া যেত, তা দিয়েই বোনা হতো মসলিন কাপড়। মসলিনে তৈরি করা পোশাকসমূহ এতই সুক্ষ্ম ছিলো যে ৫০ মিটার দীর্ঘ মসলিনের কাপড়কে একটি দিয়াশলাই বাক্সে ভরে রাখা যেতো।
কথিত আছে যে, চল্লিশ হাত লম্বা এবং দুই হাত চওড়া মসলিন সাধারণ আংটির ভেতর অনায়াসে প্রবেশ করানো যেত। মসলিন তৈরিতে যে বিশেষ সূতা ব্যবহৃত হত তার এক পাউন্ডের দৈর্ঘ্য প্রায় আড়াইশ মাইল হত।
প্রকারভেদ
মসলিনের পার্থক্য করা হতো সূক্ষ্মতা, বুননশৈলী আর নকশার পার্থক্যে।এরই প্রেক্ষিতে বিভিন্ন প্রকার মসলিনের আলাদা আলাদা নাম হয়ে যায়।
মলবুস খাস
'মলবুস খাস' মানেই হলো খাস বস্ত্র বা আসল কাপড়। এজাতীয় মসলিন সবচেয়ে সেরা আর এগুলো তৈরি হতো সম্রাটদের জন্য। আঠারো শতকের শেষদিকে মলবুস খাসের মতো আরেক প্রকারের উঁচুমানের মসলিন তৈরি হতো, যার নাম 'মলমল খাস'। এগুলো লম্বায় ১০ গজ, প্রস্থে ১ গজ, আর ওজন হতো ৬-৭ তোলা। ছোট্ট একটা আংটির মধ্যে দিয়ে এ কাপড় নাড়াচাড়া করা যেতো। এগুলো সাধারণত রপ্তানি করা হতো।
সরকার-ই-আলা
এ মসলিনও মলবুস খাসের মতোই উঁচুমানের ছিলো। বাংলার নবাব বা সুবাদারদের জন্য তৈরি হতো এই মসলিন। সরকার-ই-আলা নামের জায়গা থেকে পাওয়া খাজনা দিয়ে এর দাম শোধ করা হতো বলে এর এরকম নামকরণ। লম্বায় হতো ১০ গজ, চওড়ায় ১ গজ আর ওজন হতো প্রায় ১০ তোলা।
ঝুনা
'ঝুনা' শব্দটি, জেমস টেইলরের মতে, এসেছে হিন্দী ঝিনা থেকে, যার অর্থ হলো সূক্ষ্ম। ঝুনা মসলিনও সূক্ষ্ম সুতা দিয়ে তৈরি হতো, তবে সুতার পরিমাণ থাকতো কম। তাই এজাতীয় মসলিন হাল্কা জালের মতো হতো দেখতে। একেক টুকরা ঝুনা মসলিন লম্বায় ২০ গজ, প্রস্থে ১ গজ হতো। ওজন হতো মাত্র ২০ তোলা। এই মসলিন বিদেশে রপ্তানি করা হতো না, পাঠানো হতো মোঘল রাজ দরবারে। সেখানে দরবারের বা হারেমের মহিলারা গরমকালে এ মসলিনের তৈরি জামা গায়ে দিতেন।
আব-ই-রওয়ান
আব-ই-রওয়ান ফারসি শব্দ, অর্থ প্রবাহিত পানি। এই মসলিনের সূক্ষ্মতা বোঝাতে প্রবাহিত পানির মতো টলটলে উপমা থেকে এর নামই হয়ে যায়। লম্বায় হতো ২০ গজ, চওড়ায় ১ গজ, আর ওজন হতো ২০ তোলা।আব-ই-রওয়ান সম্পর্কে প্রচলিত গল্পগুলোর সত্যতা নিরূপন করা না গেলেও উদাহরণ হিসেবে বেশ চমৎকার। যেমন: একবার সম্রাট আওরঙ্গজেবের দরবারে তাঁর মেয়ে উপস্থিত হলে তিনি মেয়ের প্রতি রাগান্বিত হয়ে বললেন তোমার কি কাপড়ের অভাব নাকি? তখন মেয়ে আশ্চর্য হয়ে জানায় সে আব-ই-রওয়ানের তৈরি সাতটি জামা গায়ে দিয়ে আছে। অন্য আরেকটি গল্পে জানা যায়, নবাব আলীবর্দী খান বাংলার সুবাদার থাকাকালীন তাঁর জন্য তৈরি এক টুকরো আব-ই-রওয়ান ঘাসের উপর শুকোতে দিলে একটি গরু এতোটা পাতলা কাপড় ভেদ করে ঘাস আর কাপড়ের পার্থক্য করতে না পেরে কাপড়টা খেয়ে ফেলে। এর খেসারৎস্বরূপ আলীবর্দী খান ঐ চাষীকে ঢাকা থেকে বের করে দেন।
খাসসা
ফারসি শব্দ খাসসা। এই মসলিন ছিলো মিহি আর সূক্ষ্ম, অবশ্য বুনন ছিলো ঘন। ১৭ শতকে সোনারগাঁ বিখ্যাত ছিলো খাসসার জন্য। ১৮-১৯ শতকে আবার জঙ্গলবাড়ি বিখ্যাত ছিলো এ মসলিনের জন্য। তখন একে 'জঙ্গল খাসসা' বলা হতো। অবশ্য ইংরেজরা একে ডাকতো 'কুষা' বলে।
শবনম
'শবনম' কথাটার অর্থ হলো ভোরের শিশির। ভোরে যদি শবনম মসলিন শিশির ভেজা ঘাসে শুকোতে দেয়া হলে শবনম দেখাই যেতোনা, এতোটাই মিহী আর সূক্ষ্ম ছিলো এই মসলিন। ২০ গজ লম্বা আর ১ গজ প্রস্থের শবনমের ওজন হতো ২০ থেকে ২২ তোলা।
নয়ন সুখ
মসলিনের একমাত্র এই নামটিই বাংলায়। সাধারণত গলাবন্ধ রুমাল হিসেবে এর ব্যবহার হতো। এজাতীয় মসলিনও ২০ গজ লম্বা আর ১ গজ চওড়া হতো।
বদন খাস
এজাতীয় মসলিনের নাম থেকে ধারণা করা হয় সম্ভবত শুধু জামা তৈরিতে এ মসলিন ব্যবহৃত হতো, কারণ 'বদন' মানে শরীর। এর বুনন ঘন হতো না। এগুলো ২৪ গজ লম্বা আর দেড় গজ চওড়া হতো, ওজন হতো ৩০ তোলা।
সর-বন্ধ
ফারসি শব্দ সর-বন্ধ মানে হলো মাথা বাঁধা। প্রাচীন বাংলা উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা মাথায় পাগড়ি বাঁধতেন, যাতে ব্যবহৃত হতো সার-বন্ধ। লম্বায় ২০-২৪ গজ আর চওড়ায় আধা থেকে এক গজ হতো; ওজন হতো ৩০ তোলা।
ডোরিয়া
ডোরা কাটা মসলিন 'ডোরিয়া' বলে পরিচিত ছিলো। লম্বায় ১০-১২ গজ আর চওড়ায় ১ গজ হতো। শিশুদের জামা তৈরি করে দেয়া হতো ডোরিয়া দিয়ে।
জামদানী
বর্তমানে বাংলাদেশে জামদানী নামে এক প্রকার পাতলা কাপড়ের শাড়ি পাওয়া যায়। তবে আগেকার যুগে 'জামদানী' বলতে বোঝানো হতো নকশা করা মসলিনকে।
এছাড়াও আরো বিভিন্ন প্রকারের মসলিন ছিলো: 'রঙ্গ', 'আলিবালি', 'তরাদ্দাম', 'তনজেব', 'সরবুটি', 'চারকোনা' ইত্যাদি।
বিলুপ্তি
সে সময় মোঘল সম্রাট ও স্থানীয় নওয়াবদের পৃষ্ঠপোষকতায় মসলিন শিল্পের বেশ প্রসার ঘটে। তারা মসলিনের বড় ক্রেতাও ছিলেন। মসলিন বাণিজ্যের জন্য ঢাকায় বিভিন্ন ইউরোপীয় বণিকের আগমন ঘটে। সে সময় ঢাকায় ইউরোপীয় পণ্যের বিশেষ চাহিদা না থাকায় ইউরোপীয়রা নগদ টাকা এবং সোনা-রুপা নিয়ে আসতে থাকে। তবে ধীরে ধীরে স্থানীয় শাসকগণ রাজনৈতিকভাবে বেকায়দায় পড়ার কারণে মসলিনের পৃষ্ঠপোষকতা বন্ধ হয়, অভিজাত ক্রেতাও হারায় ঢাকাই মসলিন। পলাশীর যুদ্ধের পর কোম্পানী এবং কোম্পানী নিযুক্ত দেশীয় কর্মচারীদের নিগ্রহ তাঁতীদের অবস্থাকে আরও শোচনীয় করে তোলে।
ভারতে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে ইউরোপীয় বস্ত্রকে সুবিধা দিতে বৈষম্যমূলক শুল্ক ব্যবস্থা চালু করা হয়। এ সময় স্থানীযভাবে প্রস্তুত করা বস্ত্রের উপরে ৭০ হতে ৮০ শতাংশ কর আরোপ করা হয়, যেখানে ব্রিটেনে প্রস্তুত করা আমদানীকৃত কাপড়ের উপরে মাত্র ২ থেকে ৪ শতাংশ কর ছিলো।এছাড়া শিল্পের উন্নতিও ভারতীয় উপমহাদেশের মসলিনের পতন ডেকে আনে।
কথিত আছে, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকেরা মসলিন উৎপাদন বন্ধ করার জন্য মসলিন বয়নকারী তাঁতিদের হাতের বুড়ো আঙুল কেটে নেয। তবে অধুনা অন্য আরেকটু দাবি বেশ যৌক্তিকভাবে সামনে উঠে এসেছে, তা হলো, তাঁতিদের হাত ব্রিটিশরা নয়, বরং তারা নিজেরাই নিজেদের আঙ্গুল কেটে নিতো, যাতে এই তাঁতের কাজ আর না করতে হয়।বিশেষ তথ্য সে সময় ভারতে প্রস্তুতকৃত অন্য সূক্ষ্ণ বস্ত্রও ইউরোপে মসলিন নামে পরিচিত ছিল। তবে ঢাকাই মসলিন তার গুণের কারণে বিশেষ জায়গা করে নেয়।
উপসংহার:
ঢাকাই মসলিন আর নেই। কিন্তু মসলিন এখনো ঢাকার গর্বের প্রতীক। কেবল ভারতীয় শাসকের অন্ত:পুর নয়, মসলিন মাতিয়ে রেখেছিল রোমান সাম্রাজ্য, মধ্যপ্রাচ্য, চীন এবং ইউরোপের বাজার। ১৮৫১ সালে লন্ডনের প্রদর্শনীতে মসলিন বিপুল প্রশংসা লাভ করে, সেখানকার পত্র পত্রিকায়ও বেশ আলোচনা হয় ঢাকাই মসলিন নিয়ে। মসলিন আজ নেই, তবে মসলিনের ঐতিহ্য নিয়ে টিকে আছে জামদানী।
বাংলার বস্ত্রশিল্পের ঐতিহ্য বেশ পুরনো। মোগল আমলে বাংলার রাজধানী ঢাকায়স্থানান্তরিত হওয়ার পর ঢাকায় বিশেষ এক ধরনের অতি সূক্ষ্ম কাপড় তৈরি করাহতো; যা মসলিন নামে খ্যাত ছিল। মসলিন কাপড়েরবুনন
অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও মিহি হওয়ার কারণে ১৮৫১ সালে লন্ডনের বস্ত্রপ্রদর্শনীতে ঢাকাই মসলিন বিশেষ প্রাধান্য পায় এবং দর্শকদের মুগ্ধ করে।মসলিনের বিভিন্ন ধরন ছিল। আর সবচেয়ে সূক্ষ্ম মসলিন কাপড়ের নাম ছিল মলমল।মলমল ছিল সে সময় সবচেয়ে দামি বস্ত্র এবং এক প্রস্থ মলমল তৈরি করতে তাঁতিদেরছয় মাস পর্যন্ত সময় লেগে যেত। মোগল সম্রাট ও অভিজাতদের পৃষ্ঠপোষকতাতেই সেসময় মসলিন শিল্পের প্রসার ঘটে। এক হিসাবে দেখা যায়, ১৭৪৭ সালে ঢাকা থেকে যেপরিমাণ মসলিন কাপড় রপ্তানি ও নবাবদের জন্য সংগ্রহ করা হতো তার মূল্য ছিল২৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা। কিন্তু পলাশীর যুদ্ধের পর থেকে মূল্যবান এই কাপড়বিপর্যয়ের মুখে পরে এবং ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লবের পরে দেশি বাদশাহ্, নবাবও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে পুরোপুরি বিলীন হয়ে যায় ঐতিহ্যবাহী এই সূক্ষ্ম বস্ত্র।
শব্দের উৎস
বাংলা মসলিন শব্দটি আরবি, ফারসি কিংবা সংস্কৃতমূল শব্দ নয়।মসলিন নামটির উৎপত্তি সম্পর্কে সঠিক তথ্যপাওয়া না গেলেও এস. সি. বার্নেল ও হেনরি ইউল নামের দুজন ইংরেজ কর্তৃক প্রকাশিত অভিধান "হবসন জবসন"-এ উল্লেখ করা হয়েছে মসলিন শব্দটি এসেছে 'মসূল' থেকে। ইরাকের এক বিখ্যাত ব্যবসাকেন্দ্র হলো মসূল। এই মসূলেও অতি সূক্ষ্ম কাপড় প্রস্তুত হতো। এই 'মসূল' এবং 'সূক্ষ্ম কাপড়' -এ দুয়ের যোগসূত্র মিলিয়ে ইংরেজরা অতিসূক্ষ্ম কাপড়ের নাম দেয় 'মসলিন'।অবশ্য বাংলার ইতিহাসে 'মসলিন' বলতে বোঝানো হয় তৎকালীন ঢাকা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে উৎপাদিত অতি সূক্ষ্ম একপ্রকার কাপড়কে।
বিবরণ
মসলিন মূলতো প্রস্তুত করা হতো পূর্ব বাংলার সোনারগাঁও অঞ্চলে। ঢাকার কয়েকটি স্থান ছিল উৎকৃষ্টমানের মসলিনতৈরির জন্য প্রসিদ্ধ। তবে কিশোরগঞ্জের জঙ্গলবাড়িতে অত্যন্ত সূক্ষ্ম মসলিনকাপড় তৈরি করা হতো; কারণ এই এলাকাটি মসলিন তৈরির উপযোগী তুলা উৎপাদনকারীস্থানের কাছাকাছি ছিল। ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে জন্মানো ফুটি নামের এক ধরনেরতুলা থেকে যে সুতা পাওয়া যেত, তা দিয়েই বোনা হতো মসলিন কাপড়। মসলিনে তৈরি করা পোশাকসমূহ এতই সুক্ষ্ম ছিলো যে ৫০ মিটার দীর্ঘ মসলিনের কাপড়কে একটি দিয়াশলাই বাক্সে ভরে রাখা যেতো।
কথিত আছে যে, চল্লিশ হাত লম্বা এবং দুই হাত চওড়া মসলিন সাধারণ আংটির ভেতর অনায়াসে প্রবেশ করানো যেত। মসলিন তৈরিতে যে বিশেষ সূতা ব্যবহৃত হত তার এক পাউন্ডের দৈর্ঘ্য প্রায় আড়াইশ মাইল হত।
প্রকারভেদ
মসলিনের পার্থক্য করা হতো সূক্ষ্মতা, বুননশৈলী আর নকশার পার্থক্যে।এরই প্রেক্ষিতে বিভিন্ন প্রকার মসলিনের আলাদা আলাদা নাম হয়ে যায়।
মলবুস খাস
'মলবুস খাস' মানেই হলো খাস বস্ত্র বা আসল কাপড়। এজাতীয় মসলিন সবচেয়ে সেরা আর এগুলো তৈরি হতো সম্রাটদের জন্য। আঠারো শতকের শেষদিকে মলবুস খাসের মতো আরেক প্রকারের উঁচুমানের মসলিন তৈরি হতো, যার নাম 'মলমল খাস'। এগুলো লম্বায় ১০ গজ, প্রস্থে ১ গজ, আর ওজন হতো ৬-৭ তোলা। ছোট্ট একটা আংটির মধ্যে দিয়ে এ কাপড় নাড়াচাড়া করা যেতো। এগুলো সাধারণত রপ্তানি করা হতো।
সরকার-ই-আলা
এ মসলিনও মলবুস খাসের মতোই উঁচুমানের ছিলো। বাংলার নবাব বা সুবাদারদের জন্য তৈরি হতো এই মসলিন। সরকার-ই-আলা নামের জায়গা থেকে পাওয়া খাজনা দিয়ে এর দাম শোধ করা হতো বলে এর এরকম নামকরণ। লম্বায় হতো ১০ গজ, চওড়ায় ১ গজ আর ওজন হতো প্রায় ১০ তোলা।
ঝুনা
'ঝুনা' শব্দটি, জেমস টেইলরের মতে, এসেছে হিন্দী ঝিনা থেকে, যার অর্থ হলো সূক্ষ্ম। ঝুনা মসলিনও সূক্ষ্ম সুতা দিয়ে তৈরি হতো, তবে সুতার পরিমাণ থাকতো কম। তাই এজাতীয় মসলিন হাল্কা জালের মতো হতো দেখতে। একেক টুকরা ঝুনা মসলিন লম্বায় ২০ গজ, প্রস্থে ১ গজ হতো। ওজন হতো মাত্র ২০ তোলা। এই মসলিন বিদেশে রপ্তানি করা হতো না, পাঠানো হতো মোঘল রাজ দরবারে। সেখানে দরবারের বা হারেমের মহিলারা গরমকালে এ মসলিনের তৈরি জামা গায়ে দিতেন।
আব-ই-রওয়ান
আব-ই-রওয়ান ফারসি শব্দ, অর্থ প্রবাহিত পানি। এই মসলিনের সূক্ষ্মতা বোঝাতে প্রবাহিত পানির মতো টলটলে উপমা থেকে এর নামই হয়ে যায়। লম্বায় হতো ২০ গজ, চওড়ায় ১ গজ, আর ওজন হতো ২০ তোলা।আব-ই-রওয়ান সম্পর্কে প্রচলিত গল্পগুলোর সত্যতা নিরূপন করা না গেলেও উদাহরণ হিসেবে বেশ চমৎকার। যেমন: একবার সম্রাট আওরঙ্গজেবের দরবারে তাঁর মেয়ে উপস্থিত হলে তিনি মেয়ের প্রতি রাগান্বিত হয়ে বললেন তোমার কি কাপড়ের অভাব নাকি? তখন মেয়ে আশ্চর্য হয়ে জানায় সে আব-ই-রওয়ানের তৈরি সাতটি জামা গায়ে দিয়ে আছে। অন্য আরেকটি গল্পে জানা যায়, নবাব আলীবর্দী খান বাংলার সুবাদার থাকাকালীন তাঁর জন্য তৈরি এক টুকরো আব-ই-রওয়ান ঘাসের উপর শুকোতে দিলে একটি গরু এতোটা পাতলা কাপড় ভেদ করে ঘাস আর কাপড়ের পার্থক্য করতে না পেরে কাপড়টা খেয়ে ফেলে। এর খেসারৎস্বরূপ আলীবর্দী খান ঐ চাষীকে ঢাকা থেকে বের করে দেন।
খাসসা
ফারসি শব্দ খাসসা। এই মসলিন ছিলো মিহি আর সূক্ষ্ম, অবশ্য বুনন ছিলো ঘন। ১৭ শতকে সোনারগাঁ বিখ্যাত ছিলো খাসসার জন্য। ১৮-১৯ শতকে আবার জঙ্গলবাড়ি বিখ্যাত ছিলো এ মসলিনের জন্য। তখন একে 'জঙ্গল খাসসা' বলা হতো। অবশ্য ইংরেজরা একে ডাকতো 'কুষা' বলে।
শবনম
'শবনম' কথাটার অর্থ হলো ভোরের শিশির। ভোরে যদি শবনম মসলিন শিশির ভেজা ঘাসে শুকোতে দেয়া হলে শবনম দেখাই যেতোনা, এতোটাই মিহী আর সূক্ষ্ম ছিলো এই মসলিন। ২০ গজ লম্বা আর ১ গজ প্রস্থের শবনমের ওজন হতো ২০ থেকে ২২ তোলা।
নয়ন সুখ
মসলিনের একমাত্র এই নামটিই বাংলায়। সাধারণত গলাবন্ধ রুমাল হিসেবে এর ব্যবহার হতো। এজাতীয় মসলিনও ২০ গজ লম্বা আর ১ গজ চওড়া হতো।
বদন খাস
এজাতীয় মসলিনের নাম থেকে ধারণা করা হয় সম্ভবত শুধু জামা তৈরিতে এ মসলিন ব্যবহৃত হতো, কারণ 'বদন' মানে শরীর। এর বুনন ঘন হতো না। এগুলো ২৪ গজ লম্বা আর দেড় গজ চওড়া হতো, ওজন হতো ৩০ তোলা।
সর-বন্ধ
ফারসি শব্দ সর-বন্ধ মানে হলো মাথা বাঁধা। প্রাচীন বাংলা উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা মাথায় পাগড়ি বাঁধতেন, যাতে ব্যবহৃত হতো সার-বন্ধ। লম্বায় ২০-২৪ গজ আর চওড়ায় আধা থেকে এক গজ হতো; ওজন হতো ৩০ তোলা।
ডোরিয়া
ডোরা কাটা মসলিন 'ডোরিয়া' বলে পরিচিত ছিলো। লম্বায় ১০-১২ গজ আর চওড়ায় ১ গজ হতো। শিশুদের জামা তৈরি করে দেয়া হতো ডোরিয়া দিয়ে।
জামদানী
বর্তমানে বাংলাদেশে জামদানী নামে এক প্রকার পাতলা কাপড়ের শাড়ি পাওয়া যায়। তবে আগেকার যুগে 'জামদানী' বলতে বোঝানো হতো নকশা করা মসলিনকে।
এছাড়াও আরো বিভিন্ন প্রকারের মসলিন ছিলো: 'রঙ্গ', 'আলিবালি', 'তরাদ্দাম', 'তনজেব', 'সরবুটি', 'চারকোনা' ইত্যাদি।
বিলুপ্তি
সে সময় মোঘল সম্রাট ও স্থানীয় নওয়াবদের পৃষ্ঠপোষকতায় মসলিন শিল্পের বেশ প্রসার ঘটে। তারা মসলিনের বড় ক্রেতাও ছিলেন। মসলিন বাণিজ্যের জন্য ঢাকায় বিভিন্ন ইউরোপীয় বণিকের আগমন ঘটে। সে সময় ঢাকায় ইউরোপীয় পণ্যের বিশেষ চাহিদা না থাকায় ইউরোপীয়রা নগদ টাকা এবং সোনা-রুপা নিয়ে আসতে থাকে। তবে ধীরে ধীরে স্থানীয় শাসকগণ রাজনৈতিকভাবে বেকায়দায় পড়ার কারণে মসলিনের পৃষ্ঠপোষকতা বন্ধ হয়, অভিজাত ক্রেতাও হারায় ঢাকাই মসলিন। পলাশীর যুদ্ধের পর কোম্পানী এবং কোম্পানী নিযুক্ত দেশীয় কর্মচারীদের নিগ্রহ তাঁতীদের অবস্থাকে আরও শোচনীয় করে তোলে।
ভারতে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে ইউরোপীয় বস্ত্রকে সুবিধা দিতে বৈষম্যমূলক শুল্ক ব্যবস্থা চালু করা হয়। এ সময় স্থানীযভাবে প্রস্তুত করা বস্ত্রের উপরে ৭০ হতে ৮০ শতাংশ কর আরোপ করা হয়, যেখানে ব্রিটেনে প্রস্তুত করা আমদানীকৃত কাপড়ের উপরে মাত্র ২ থেকে ৪ শতাংশ কর ছিলো।এছাড়া শিল্পের উন্নতিও ভারতীয় উপমহাদেশের মসলিনের পতন ডেকে আনে।
কথিত আছে, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকেরা মসলিন উৎপাদন বন্ধ করার জন্য মসলিন বয়নকারী তাঁতিদের হাতের বুড়ো আঙুল কেটে নেয। তবে অধুনা অন্য আরেকটু দাবি বেশ যৌক্তিকভাবে সামনে উঠে এসেছে, তা হলো, তাঁতিদের হাত ব্রিটিশরা নয়, বরং তারা নিজেরাই নিজেদের আঙ্গুল কেটে নিতো, যাতে এই তাঁতের কাজ আর না করতে হয়।বিশেষ তথ্য সে সময় ভারতে প্রস্তুতকৃত অন্য সূক্ষ্ণ বস্ত্রও ইউরোপে মসলিন নামে পরিচিত ছিল। তবে ঢাকাই মসলিন তার গুণের কারণে বিশেষ জায়গা করে নেয়।
উপসংহার:
ঢাকাই মসলিন আর নেই। কিন্তু মসলিন এখনো ঢাকার গর্বের প্রতীক। কেবল ভারতীয় শাসকের অন্ত:পুর নয়, মসলিন মাতিয়ে রেখেছিল রোমান সাম্রাজ্য, মধ্যপ্রাচ্য, চীন এবং ইউরোপের বাজার। ১৮৫১ সালে লন্ডনের প্রদর্শনীতে মসলিন বিপুল প্রশংসা লাভ করে, সেখানকার পত্র পত্রিকায়ও বেশ আলোচনা হয় ঢাকাই মসলিন নিয়ে। মসলিন আজ নেই, তবে মসলিনের ঐতিহ্য নিয়ে টিকে আছে জামদানী।
No comments:
Post a Comment